সাইবার দুনিয়ায় কন্যাদের পথ দেখায় কন্যাকথা
মেয়েটা থাকে লালমনিরহাট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় প্রেম পর্যন্ত গড়াতে খুব সময় লাগে না। বিশ্বাস করে ব্যক্তিগত কিছু ছবিও সে ছেলেটার সঙ্গে শেয়ার করে। ‘মোক্ষম অস্ত্র’ হাতে পেয়ে আর দেরি করেনি সেই যুবক। ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জলদি পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে বলে। স্কুলপড়ুয়া কিশোরী, তার জন্য পাঁচ হাজার টাকাই অনেক। অত টাকা সে কোথায় পাবে? কিন্তু ছবি যদি ভাইরাল হয়ে যায়? আবার বাসায়ও বলা যাবে না।
বন্ধুদের মাধ্যমে কন্যাকথা সম্পর্কে তার জানা ছিল। নিজেই ফোন করে কন্যাকথার সাহায্য চায় ওই কিশোরী। তড়িৎ গতিতে সহায়তা পেয়েও যায়। নেত্রকোনা থেকে অভিযুক্ত যুবককে সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সাইবারজগতের বিপদ-আপদ সম্পর্কে কিশোরীদের সচেতন করতেই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগ ‘কন্যাকথা’। এ নামে তাদের একটি ওয়েবসাইটও আছে। সারা দেশের কিশোরী এবং তাদের অভিভাবকদের সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয় তারা। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে কিশোরীরা। আর শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই ক্ষান্ত হয় না কন্যাকথা। জেলা পর্যায়ে তাদের কিশোরী প্রতিনিধিও রয়েছে। প্রতিনিয়ত অনলাইনে তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। কন্ট্রোলার অব সার্টিফায়িং অথরিটি (সিসিএ) কার্যালয়ের অধীনে এ প্ল্যাটফর্ম পরিচালিত হয়।
২০১৭ সাল থেকেই সিসিএ কার্যালয়ের সাইবার অপরাধ বিষয়ে কিশোরীদের সচেতন করার একটি কার্যক্রম চালু ছিল। ২০২০ সালে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হলে কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে একই বছরের অক্টোবর থেকে অনলাইনে কন্যাকথা নামে কার্যক্রমটি নতুন উদ্যমে শুরু হয়। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশের ৮৮ হাজার ৭৪৯ জন শিক্ষার্থী সাইবার সচেতনতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
কন্যাকথার উদ্যোক্তা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সিসিএ কার্যালয়ের উপসচিব হাসিনা বেগম। সংস্থাটির সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা বিভাগের তিনি উপনিয়ন্ত্রক। লালমনিরহাটের সেই কিশোরীকে তিনিই অভয় দেন, পরিবারকে বোঝান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করান।
কিশোরীদের সাইবারজগৎ সম্পর্কে সচেতন করার গুরুত্ব তুলে ধরে হাসিনা বেগম বলেন, দেশ যত ডিজিটাল হচ্ছে, এ-সংক্রান্ত অপরাধের ঝুঁকিও তত বাড়ছে। বিশেষ করে করোনার সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম সব অনলাইনে হয়েছে। ফলে সাইবার অপরাধও বেড়েছে। কিশোরীরা এখানে অনেক নাজুক। তাই তাদের নিয়ে কাজ করার তাগিদ থেকেই কন্যাকথা।
কোনো কিশোরী যখন সাইবার অপরাধের শিকার হয়, তার প্রথম দরকার কাউন্সেলিং এবং যত দ্রুত সম্ভব অপরাধী শনাক্ত করা। নয়তো ভুক্তভোগী আরও হেনস্তার শিকার হতে পারে বলে মনে করেন হাসিনা বেগম। লালমনিরহাটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ওই কিশোরীকে মানসিকভাবে শক্ত রাখার পাশাপাশি তার পরিবারকেও কাউন্সেলিং করাতে হয়েছে। এসব ঘটনায় পরিবারগুলো কিশোরীদের বকাঝকা করে, তাদের দায়ী করে। এতে অভিমান করে অনেকে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তাই কন্যাকথার প্রশিক্ষণগুলোতে কিশোরীর পাশাপাশি তার মাকেও উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
সারা দেশে কন্যাকথার ৭৪ জন জেলা অ্যাম্বাসেডর আছে। তারা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বন্ধুদের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালায়। নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের একজন অ্যাম্বাসেডর রিয়া সাহা বলে, সাইবারজগৎ নিয়ে তেমন কোনো ধারণা আগে তার ছিল না। বছরখানেক আগে কন্যাকথার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক কিছু জেনেছে। এখন নিজেই অন্যদেরও এ বিষয়ে জানিয়ে থাকে।
প্ল্যাটফর্মটিতে কিশোরীরা নিজেরাই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। তারা নিজেদের কথা ভাগাভাগি করে। সাইটে নানান বিষয়ে প্রশ্নোত্তর দেওয়া আছে, সেখান থেকেও নিজেরা উপকৃত হতে পারে। এ পর্যন্ত ৬৬৭ জন কিশোরী এখানে নিবন্ধন করেছে।
কন্যাকথার সচেতনতা প্রোগ্রাম ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। পাশের দেশ ভারত থেকেও অনেক শিক্ষার্থী এ অনুষ্ঠান দেখে থাকে বলে জানান হাসিনা বেগম। তাঁর এ কাজের জন্য গত নভেম্বরে কলকাতার আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটি তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।
হাসিনা বেগম বলেন, প্ল্যাটফর্মটিকে আরও বড় পরিসরে করার ইচ্ছা আছে। কিশোরীদের পাশাপাশি কিশোরদেরও এখানে ভবিষ্যতে যুক্ত করা হবে।